বদ্রীনাথ মন্দির হল ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের বদ্রীনাথ শহরে অবস্থিত একটি মন্দির। এই মন্দিরের অপর নাম বদ্রীনারায়ণ মন্দির। এটি একটি বিষ্ণুমন্দির। বদ্রীনাথ শহর ও বদ্রীনারায়ণ মন্দির ‘চারধাম’ ও ‘ছোটো চারধাম’ নামে পরিচিত তীর্থগুলির অন্যতম। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষভাগ থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ছয় মাস এই মন্দিরটি খোলা থাকে। শীতকালে হিমালয় অঞ্চলের তীব্র প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ওই সময় এই মন্দির বন্ধ রাখা হয়। উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলায় গাড়ওয়াল পার্বত্য অঞ্চলে অলকানন্দা নদীর তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,১৩৩ মি (১০,২৭৯ ফু) উচ্চতায় এই মন্দিরটি অবস্থিত। বদ্রীনাথ ভারতের জনপ্রিয় তীর্থগুলির একটি। এখানে ২০১২ সালে ১,০৬০,০০০ জন তীর্থযাত্রী তীর্থ করতে আসেন।
এই মন্দিরের প্রধান দেবতা বিষ্ণু ‘বদ্রীনারায়ণ’ নামে পূজিত হন। বদ্রীনারায়ণের ১ মি (৩.৩ ফু) উচ্চতার বিগ্রহটি কষ্টিপাথরে নির্মিত। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এটি বিষ্ণুর আটটি ‘স্বয়ং ব্যক্ত ক্ষেত্র’ স্বয়ং-নির্মিত বিগ্রহের একটি।
বদ্রীনাথ মন্দিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবটি হল ‘মাতা মূর্তি কা মেলা’। গঙ্গার পৃথিবীতে অবতরণকে স্মরণ করে এই উৎসব পালন করা হয়। বদ্রীনাথ মন্দিরটি উত্তর ভারতে অবস্থিত হলেও এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত বা ‘রাওয়াল’রা দক্ষিণ ভারতের কেরল রাজ্যের নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে নির্বাচিত হন। মন্দিরটি উত্তরপ্রদেশ রাজ্য সরকার আইন নং ৩০/১৯৪৮ (আইন নং ১৬,১৯৩৯)-এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই আইনটি পরে শ্রীবদ্রীনাথ ও শ্রীকেদারনাথ মন্দির আইন নামে পরিচিত হয়। বদ্রীনাথ ও কেদারনাথ মন্দির কমিটির সদস্যরা রাজ্য সরকারের প্রশাসকদের দ্বারা মনোনীত হন। এই বোর্ডে সতেরো জন সদস্য আছেন।
প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বিষ্ণুপুরাণ ও স্কন্দপুরাণ-এ এই মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ-৯ম শতাব্দীতে আলোয়ার সন্তদের রচিত তামিল আনুশাসনিক ধর্মগ্রন্থ দিব্য প্রবন্ধ-তেও এই মন্দিরের ধর্মীয় মাহাত্ম্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মন্দিরের ঠিক নিচে তপ্তকুণ্ড নামে একটি উষ্ণ গন্ধক প্রস্রবন রয়েছে। এটির ঔষধিগুণ আছে বলে মনে করা হয়। অনেক তীর্থযাত্রী মনে করেন, মন্দিরে যাওয়ার আগে এই কুণ্ডে স্নান করা আবশ্যক। এই প্রস্রবনের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ৫৫ °সে (১৩১ °ফা); অন্যদিকে প্রস্রবনের বাইরে এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১৭ °সে (৬৩ °ফা)-এর নিচে থাকে।মন্দিরের দুটি পুকুরের নাম নারদ কুণ্ড ও সূর্যকুণ্ড।
প্রাচীন এই মন্দিরটিকে বহুবার মেরামত করতে হয়েছে। ১৭শ শতাব্দীতে গাড়ওয়ালের রাজারা মন্দিরটিকে প্রসারিত করেন। ১৮০৩ সালের হিমালয়ের ভূমিকম্পে মন্দিরটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপর জয়পুরের রাজা এটিকে পুনর্নির্মাণ করেন।২০০৬ সালে রাজ্য সরকার বদ্রীনাথ-সংলগ্ন এলাকায় কোনো রকম নির্মাণকাজ আইনত নিষিদ্ধ করে দেয়।
পুরাণ অনুসারে, এই স্থানে বিষ্ণু ধ্যানে বসেছিলেন। হিমালয়ের একটি অঞ্চলে মাংসভুক সন্ন্যাসী ও অসাধু লোকজন বাস করত। এই স্থানটি তার থেকে দূরে ছিল বলে বিষ্ণু ধ্যানের জন্য এই স্থানটিকে নির্বাচিত করেন। ধ্যানের সময় বিষ্ণু এখানকার দারুণ শীত সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মী একটি বদ্রী গাছের আকারে তাঁকে রক্ষা করেন। লক্ষ্মীর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু এই অঞ্চলের নাম দেন বদরিকাশ্রম। আটকিনসনের মতে (১৯৭৯), এই অঞ্চলে এক সময় একটি বদ্রী গাছের জঙ্গল ছিল। কিন্তু সেই জঙ্গল আজ আর দেখা যায় না। এই মন্দিরের বদ্রীনাথ-রূপী বিষ্ণুর মূর্তিটি পদ্মাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখা যায়। পুরাণ অনুসারে, এক ঋষি লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর পাদসেবা করতে দেখেন। তাই দেখে তিনি বিষ্ণুকে তিরস্কার করেছিলেন। সেই জন্য বিষ্ণু বদ্রীনাথে এসে দীর্ঘ সময় পদ্মাসনে বসে তপস্যা করেছিলেন।
বিষ্ণুপুরাণ-এ বদ্রীনাথের উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি উপাখ্যান পাওয়া যায়। এই উপাখ্যান অনুসারে, ধর্মের দুই পুত্র ছিল – নর ও নারায়ণ। এঁরা হিমালয়ে পর্বতরূপ ধারণ করেছিলেন। তাঁরা ধর্মপ্রচারে জন্য এই স্থানকে নির্বাচিত করেন এবং হিমালয়ের বিভিন্ন বৃহৎ উপত্যকাগুলিকে বিবাহ করেছিলেন। আশ্রম স্থাপনের জন্য উপযুক্ত জায়গার অনুসন্ধানে এসে তাঁরা পঞ্চবদ্রীর অন্যান্য চার বদ্রীর সন্ধান পান। এগুলি হল: বৃধাবদ্রী, যোগবদ্রী, ধ্যানবদ্রী ও ভবিষবদ্রী। অবশেষে তাঁরা অলকানন্দা নদী পেরিয়ে উষ্ণ ও শীতল প্রস্রবনের সন্ধান পান এবং এই স্থানটির নামকরণ করেন বদ্রীবিশাল।
হিন্দুদের সকল সম্প্রদায়ের তীর্থযাত্রীরা বদ্রীনাথ মন্দিরে তীর্থ করতে আসেন। কাশী মঠ,জীয়ার মঠ (অন্ধ্র মঠ),উডিপি পেজাভার,ও মন্ত্রালয়ম শ্রীরাঘবেন্দ্র স্বামী মঠ প্রভৃতি সকল প্রধান সন্ন্যাসী সংগঠনের শাখা ও ধর্মশালা এখানে অবস্থিত।
পঞ্চবদ্রী নামে পরিচিত পাঁচটি বিষ্ণু মন্দিরের একটি হল বদ্রীনাথ মন্দির। পঞ্চবদ্রী হল: বদ্রীনাথের বিশালবদ্রী; পাণ্ডুকেশ্বরের যোগধ্যান বদ্রী, সুবেনে জ্যোতির্মঠ থেকে ১৭ কিমি (১০.৬ মা) দূরে অবস্থিত ভবিষ্যবদ্রী, জ্যোতির্মঠ থেকে ৭ কিমি (৪.৩ মা) দূরে অনিমঠে বৃধবদ্রী ও কর্ণপ্রয়াগ থেকে ১৭ কিমি (১০.৬ মা) দূরে আদি বদ্রী। বদ্রীনাথ মন্দির হিন্দুদের পবিত্রতম চারটি তীর্থ ‘চারধাম’-এর অন্যতম। চারধাম তীর্থগুলি হল রামেশ্বরম, বদ্রীনাথ, পুরী ও দ্বারকা। যদিও এই মন্দিরের আদি ইতিহাস স্পষ্ট জানা যায় না, তবু অদ্বৈতবাদীরা আদি শঙ্করকে চারধামের প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।আদি শঙ্কর ভারতের চার প্রান্তে চারটি মঠ স্থাপন করার সময় যে চারটি মন্দিরকে মঠের নিকটবর্তী মন্দির হিসেবে নির্বাচিত করেন সেগুলি হল: উত্তরে বদ্রীনাথে বদ্রীনাথ মন্দির, পূর্বে পুরীতে জগন্নাথ মন্দির, পশ্চিমে দ্বারকায় দ্বারকাধীশ মন্দির ও দক্ষিণে শৃঙ্গেরীতে সারদাপীঠ মন্দির।
সম্প্রদায়গতভাবে চারধাম মন্দিরগুলি শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিভক্ত হলেও, সকল সম্প্রদায়ের হিন্দুরা চারধাম মন্দিরগুলিতে তীর্থ করতে আসেন। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীকে বলা হয় ‘ছোটো চারধাম’ ২০শ শতাব্দীতে মূল চারধাম থেকে এই তীর্থগুলিকে আলাদা করার জন্য ‘ছোটো’ শব্দটি যুক্ত হয়। আধুনিক কালে এই তীর্থগুলিতে তীর্থযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াও এগুলিকে ‘হিমালয়ের চারধাম’ নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে।
ভারতের চার প্রান্তে অবস্থিত চারধাম মন্দিরগুলিতে জীবনে অন্তত একবার তীর্থ করতে যাওয়া হিন্দুরা পবিত্র কর্তব্য মনে করেন। প্রথাগতভাবে, এই তীর্থযাত্রা পূর্বদিকে পূরী থেকে শুরু হয় হয় এবং রামেশ্বর ও দ্বারকা হয়ে বদ্রীনাথে পৌঁছায়।
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিজয়াদশমীর পর শীতকালের জন্য মন্দির বন্ধ হয়ে যায়। মন্দির বন্ধ হওয়ার দিন একটি ‘অখণ্ড জ্যোতি’ নামে একটি ঘৃতপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, যেটি ছয় মাস টানা জ্বলে।সেই দিন ভক্ত ও মন্দিরের আধিকারিকদের সামনে প্রধান পুরোহিত বিশেষ পূজা করেন।বদ্রীনাথের মূর্তিটিকে কাল্পনিকভাবে মন্দির থেকে ৪০ মা (৬৪ কিমি) দূরে জ্যোতির্মঠের নৃসিংহ মন্দিরে স্থানান্তরিত করা হয়। এপ্রিল মাসে বসন্তপঞ্চমী তিথিতে মন্দিরটি আবার খুলে দেওয়া হয়। তীর্থযাত্রীরা মন্দির খোলার দিন মন্দিরে উপস্থিত হন অখণ্ড জ্যোতি প্রদীপটিকে দেখার জন্য।
হিন্দুরা যে সব মন্দিরে তাঁদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পারলৌকিক ক্রিয়া সারেন, বদ্রীনাথ মন্দির সেগুলির অন্যতম।ভক্তেরা গর্ভগৃহে বদ্রীনাথের মূর্তিটি পূজা করেন এবং অলকানন্দা নদীতে স্নান করেন। লোক বিশ্বাস অনুসারে, মন্দিরের পুকুরগুলিতে স্নান করলে পাপ দূর হয়।
২০১২ সালে মন্দির কর্তৃপক্ষ দর্শনার্থীদের জন্য টোকেন ব্যবস্থা চালু করে। দর্শনের সময়-জ্ঞাপক এই টোকেনগুলি ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের তিনটি স্টল থেকে পাওয়া যায়। প্রত্যেক ভক্ত ১০-২০ সেকেন্ড বদ্রীনাথকে দর্শন করার জন্য সময় পান। পরিচয়ের প্রমাণ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। হৃষিকেশ থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব ২৯৮ কিমি (১৮৫ মা)। পথে দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, যোশীমঠ, বিষ্ণুপ্রয়াগ ও দেবদর্শিণী হয়ে হৃষীকেশ থেকে বদ্রীনাথ আসতে হয়। কেদারনাথ থেকে ২৪৩ কিমি (১৫১ মা) দীর্ঘ রুদ্রপ্রয়াগের পথ ধরে বা ২৩০ কিমি (১৪০ মা) দীর্ঘ উক্তিনাথ ও গোপেশ্বরের পথ ধরে বদ্রীনাথ আসা যায়।